জশন-এ জাকারিয়া জিন্দাবাদ !!!
- nitishb
- Apr 22, 2023
- 14 min read
জাকারিয়া স্ট্রিট, চিৎপুর, কলকাতা

এক ঈদ থেকে অন্য ঈদ অবধি, তিন ইয়ারি গপ্পো !!!
-------------------------------------------------------------------------------
২০২১
-------------------------------------------------------------------------------
পর্ব - ১
- ‘চ, খেয়ে আসি’ |
তর্কে যাওয়ার কোনো মানে ছিল না | ঈদের দিন, সুদীপ্ত হুকুম জানালো জাকারিয়া স্ট্রিট যেতে হবে | খাওয়া দাওয়ায় নাকি ভাটা পড়েছে | আমাদের জীবনে সুখ-দুঃখের ইতি নেই | দুঃখের কারণ পাল্টাতে থাকে তবে সুখের কারণ মোটামুটি সহজ সরল – খেতে পেলেই হলো | সাথে অর্ণবকেও কোনোরূপে বগলদাবা করে ওলায় পুড়লাম | সকাল সকাল নাখোদা মসজিদে লোকজনের হাঙ্গামা শেষ হয়েছে, এই পড়ন্ত সন্ধ্যায় তাই গিয়ে দেখলাম লোকজন বিশাল কম | বহুকালের স্বপ্ন আমার ঈদের দিনের জাকারিয়া স্ট্রিট-এ যাবো আর কব্জি ডুবিয়ে খাবো | তবে কপালে যথেষ্ট ঝোল ছিল না সেদিন, তাই কব্জিটা ঠিকঠাক ডুবলো না | যদিও জিভের ডগা থেকে গোঁড়া অবধি ডুবেছিল, এবার সেই গল্পেই আসবো |
১৪ -ই মে, ঈদ-উল-ফিতর
সন্ধ্যে ৬ টা,
যদি খাবার-দাবারের পরিচ্ছন্নতা নিয়ে আপনি শুচিবাইগ্রস্থ না হন, একদিন শুধুমাত্র সাধের লোভে নিজের বৃহদন্ত্র নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে রাজি থাকেন; তাহলে, রমজান-এর মাসে কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রিট-এ আপনাকে হতাশ হবে হবে না | বড়োজোর পেট রোগা হলে, খানকয়েক ডাইজিং গুঁজে পরের দিনে ঘন্টা খানেক ‘ঠাকুর ঘরে’, থুড়ি ‘লু’ তে কাটাবেন এই যা |
ঈদ মানে রমজানের শেষ দিন | তারপর বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে, এবং সর্বোপরি, করোনার জ্যাঠামো | গিয়ে যখন রাস্তাঘাটে সারিসারি রূহ-আফজার, বাদাম-পেস্তার ঠেলাগাড়ি দোকান টোকান দেখতে পেলাম না, তখন মনে হলো সব অর্ণব-এর দোষ | এখানে বলে রাখি, নিয়তির জায়গায় আমি অর্ণবকে বসিয়েছি, বহুদিন হলো | নিয়তি নাম্নী ব্যভিচারিণী, ঠিক রক্ত-মাংসের নন বলে তাকে গালি দিয়ে সুখ জোটে না | তাই তার রিপ্রেসেন্টেটিভ হিসেবে আমি অর্ণবকে গালি দি | অর্ণব এক স্তন্যপায়ী, নির্বাক, সাধু-সন্ত গোছের জীব – তাই এতে বিপদ নাই |
যাইহোক, ‘অথ কিম’? উত্তরে ঘোড়ার ডিম বলতেই যাচ্ছিলাম, হঠাৎ হাত নেড়ে আলো-আঁধারি গলির শেষ প্রান্তে সুদীপ্ত কয়েকটা খোলা দোকান দেখতে পেলো, - বোম্বে হোটেল আর দিল্লি-৬ | দিল্লি-৬ এর বাইরে শিকে ঝুলন্ত মাংস-রাজি দেখে মনে বল এলো | না, পরমাত্মার কৃপায় এযাত্রা সম্পূর্ণ বৃথা যাবে না |
দিল্লি-৬

বর্তমান ভারতের রাজধানী দিল্লী, মোঘল ঘরানার খাবার-দাবারের জন্য বিশ্ববিখ্যাত | সেই ঘরানার খাদ্য-রসায়ন অনুসারী দোকান কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রিট এর এই দিল্লি-৬ | কিন্তু প্রশ্ন আসে ৬-ই কেন? এতো ক্রিকেট খেলা নয়, যে উক্ত সংখ্যাটিতে আসক্তি থাকবে |
এর উত্তর পেতে হলে যেতে হবে চাঁদনী-চৌক এ, না আমাদের কলকাতার-টি নয়, দিল্লীতে যেটা আছে | ১৬৩৯ এ মোঘল সম্রাট শাহজাহান, আগ্রা থেকে নিজের রাজধানী সরিয়ে আনেন অধুনা পুরানো দিল্লীতে, তার তৎকালীন নাম হয় শাহ্জাহানাবাদ | ফলস্বরূপ, মোঘল খানা-পিনার কেন্দ্রস্থল হিসেবে ক্রমশ গড়ে ওঠে সেই শাহ্জাহানাবাদ, চাঁদনী-চৌক আবার তার কেন্দ্রবিন্দু | স্বাধীনতার পর, ভারতীয় ডাকবিভাগ এই অঞ্চলের পিন কোড ধার্য্য করে ৬, পুরোটা হলো ১১০০০৬ | সেখান থেকে এই অঞ্চল 'ইন-শর্ট' দিল্লী-৬ নাম প্রচার প্রায় | এই অঞ্চলের আয়তন নিতান্ত ছোট নয় | রীতিমতো সিনেমা হয়েছে এর ওপর ২০০৯ সালে | বর্তমান জাকারিয়ার দিল্লি-৬ নিজের নামকরণের মাধ্যমে সেই মোঘল ইতিহাসের সাথে সম্পর্ক প্রমানের চেষ্টা করে বইকি !
এবার আসি খাওয়ার ফর্দে :-
রুমালি রুটির সাথে চিকেন আফগানী -
আফগান রন্ধনশৈলী, আফগানিস্তানের ঘনিষ্ঠতা এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্কের কারণে পারস্য, মধ্য এশিয়া এবং ভারতীয় খাবার দ্বারা প্রভাবিত হয়। মারিনেটেড মুরগির মাংস, দই ও কাজু, আলমন্ডের পেস্ট-এ মিশিয়ে গ্রিল করে তৈরী করা এই অনবদ্য সৃষ্টি প্রথম দেখাতে গন্ধে প্রথমে মন জুড়ায়; পরে জিবে দিলে জুড়ায় আত্মা |

বাকরখানি ও একটি প্রেমের গল্প -
চলতি ভাষায় বাকার খানি রুটি, আসলে মোঘল ঘরানার ব্রেড জাতীয় খাদ্য - স্বাদে মিষ্টি, রঙে বিস্কুটের মতো | বাকরখানি রন্ধনে অনেক মুন্সিয়ানা আছে, মূলত ময়দা, সুজি, চিনি, জাফরানে ভেজানো গুড়, পোস্ত বা নাইজেলা বীজ, নুন আর ঘি সহযোগে ভালো জাতের বাকরখানি তৈরী করা হয় | এবার আসি প্রেমকাহিনিতে |
কথায় আছে, সিরাজদৌলার অধীনে থাকা চট্টগ্রামের জায়গীরদার মির্জা আগা বকর, আরামবাগের নর্তকী খানি বেগমের প্রেমে পরে যুদ্ধে জড়ায় চট্টগ্রামেরই কোতোয়াল জয়নুল খানের সাথে | এরপর বহু লড়াইয়ের গোলকধাঁধায় অনেক ঘটনা ঘটে, তলোয়ারী ভেঙে, বাঘ মরে, প্রেমিকা অপহরণ হয়; শেষমেষ খানি বেগম জয়নুলের হাতে ও জয়নুল তার নিজের বাবার হাতেই অঘোরে প্রাণ হারায় | বুক ফাটে আগা বকরের | নিজের বৌ ছেড়ে পরনারীতে 'সভ্য' সমাজের চিরকালীন আসক্তি | তাই এই অপ্রাপ্তির প্রেমের গল্প ছড়ায় দাবানলের মতো | আগা বকর আর খানি বেগমের নাম মিশিয়ে অমর করতে রুটির ব্যবসায়ীরা সৃষ্টি করেন বাকরখানি |
‘আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাকরখানি
বেচো না বেচো না বন্ধু তোমার চোখের মণি।'
— প্রতুল মুখোপাধ্যায়

শাহী টুকরা - কেউ বলে, বাবর নাকি ষোড়শ-শতাব্দী তে সাথে নিয়ে এসেছিলো; কেউবা, একে
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কালের ইউরোপীয় 'ব্রেড পুডিং' বিবর্তিত রূপ মনে করে | আমার
তবে তৃতীয় গল্পটি বেশি ভালো লাগে শুনতে |
ঘন মিষ্টি পুডিং-এ ভিজানো পাউরুটি বর্তমান শাহী টুকরার রূপ | দিদি একবার ঘরে তৈরী করেছিল, পারসী-মোঘল ঘরানার এ এক বহু সমাদৃত 'ডেজার্ট' |
তৃতীয় গল্পে আসি তাহলে, অনেক বোদ্ধা বলে, শাহী টুকরা এসেছে 'উম আলী' নামের এর প্রাচীন মিশরীয় ব্রেড পুডিং থেকে | এককালে নাকি কোন এক সুলতান একদল শিকারী নিয়ে বেরিয়ে ফেঁসে যায় নীল নদের তীরে এক গ্রামে | সেই গ্রামের রাঁধুনের নাম ছিল উম আলী | তার ওপর দায়িত্ব পরে অথিতিদের রান্নাবান্নার | গরিব গ্রামের যৎসামান্য জিনিস - কিছু বাসি রুটি, দুধ, চিনি ময়দা ও বাদাম সহযোগে তৈরী হয় এক খাদ্য যা খেয়ে তৃপ্ত সুলতান তার প্রচার করেন 'উম আলী' নামেই | সেই সুদূর নীল যদি থেকে সিন্ধু তীরে আস্তে আস্তে 'উম আলী' নাকি খানিক রূপান্তরিত হয়ে তৈরী হয় 'শাহী টুকরা' , রাঁধুনে কে ভুলে গিয়ে সমাজ স্বভাব দোষে মনে রাখে 'সুলতান' কে, তাই জুড়ে যায় থাকে 'শাহী' তকমা |

বোম্বে হোটেল এ বীফ চাপ আর রুটি অনবদ্য এটা অনেকের মুখেই শুনেছি | সেদিন আর পেট এ জায়গা ছিল না | তাছাড়া 'বীফ' খাওয়া আর 'ত্যাজ্য-পুত্র' হওয়া শব্দ দুটি আমাদের ঘরে সমার্থক | তাই তিন বন্ধু গুটি গুটি পায় বাড়ি ফিরে এলুম সেদিন |
বাকি আর কোনো দোকান খোলা ছিল না, তবে এক অস্থায়ী দোকানের থেকে কেজি খানেক সিমুই কিনতে ভুলিনি |
-------------------------------------------------------------------------------
২০২২
-------------------------------------------------------------------------------
পর্ব - ২
- 'কি বলিস সুদীপ্ত কে বলবো ?'
- 'আপত্তি নেই, তবে ও কি যাবে, বৌদির সময় হবে ?'
- 'এর চেয়ে বরং এই বার দুজনেই যাই, আরেকবার না হয় আগে থেকে বলে ওর যাওয়ার
ইচ্ছা আছে নাকি দেখবো |'
এবছর ঈদের আগেই যাবো, গতবারের অভিজ্ঞতার পর বহু আলোচনা হয়েছে | শেষদিন দোকান বেশিরভারী বন্ধ তাই আগে যেতে, পারলে রমজানের ছুটিতেই | আর যেতে হবে ৪ টের মধ্যে যাতে দোকানপাট ফাঁকা পাওয়া যায় | শনিবারই যাবো, পেট ছাড়লে অফিস খোলার আগে একদিন পাওয়া যাবে | পরিবর্তন হলো একটি, সুদীপ্ত বিয়ে করেছে | এখন আর যখন-তখন টেনে নিয়ে যাওয়া যায় না | সামিজিকতায় বাঁধ সাঝে | তাই ঠিক হলো আমি আর অর্ণব-ই যাবো |
৯-ই এপ্রিল, রমজানের প্রথম সপ্তাহ
বিকেল ৫ টা ৪০,
আমরা নাকি বিকেল ৪ টায় পৌছাবো !!! আমার জীবন যদি স্টিপলিচেস হয়, তাতে বাঁধার নাম অর্ণব দত্ত, কলি যুগে শনির অবতার; কোনো কিছু করতে বা কোথাও যেতে বললেই একই বাহানা ‘যাবো, কিন্তু ভাই..’.
বেশি বুঝিয়ে লাভ ছিল না, গত ২৬ বছরের অভিজ্ঞতায় বুঝেছি – লজিক-এর সাথে অর্ণবের সম্পর্ক নেই | এযেন মেঘনাদবধ কাব্যের বিভীষণ | যাই বলো না কেন উত্তর আসে, "বৃথা এ সাধনা ধীমান..." তাই তারা দিয়ে, গাল দিয়ে কোনোক্রমে ৫ টা ৪০ এ জাকারিয়া পৌছালাম | প্রথমেই আশাহত হতে হলো 'সুফিয়া' তে গিয়ে, হালিম ফুরুৎ | ৫ টা তেই নাকি শেষ হয়ে গেছে | অতএব পা বাড়ালাম 'তাসকিন' এর দিকে, পথের দেখি লাল বাহারি সরবতের যেন জলসা বসেছে |
৭০-এর দশকে আমার পিতৃপুরুষের কালে খান্না কাকা - কিশোর খুড়োর গলায় কেঁপে কেঁপে আফসোস করে লিপি মিলিয়ে গেছেন ‘এই হতচ্ছাড়া লাল রং, বেটাচ্ছেলে আমায় ছাড়িস না কেন’ (যেহ লাল রং) | তার সমস্যা টা এতদিনে বুঝলাম | আপনি না বুঝলে যান এখ্খুনি ইউটুবে 'প্রেম নগর' সিনেমাটি দেখে আসুন | ওতে আবার ‘স্বপ্ন-মানবী’ (ড্রিম গার্ল) আছেন, যিনি নাকি আজকাল মথুরার এতো উন্নতি করছেন যা বলে বোঝানোর উর্ধে | অথএব, আপনার না জানাই ভালো | উফ্ফ !! আবার কচকচানিতে ঢুকে পড়েছি দেখছি, ফেরত আসি আসল গল্পে |
জলের দোকানে রকমারি জল ছিল - বরফ জল, লেবু জল আর 'রূহ আফজা' বা 'লাল রঙের জল' | 'রূহ' মানে আত্মা আর 'আফজা' মানে সতেজ | তবে এই বিশেষ রূহ-আফজায় যে উচ্চমানের জল ব্যবহার হতে দেখলাম, তা গলায় ঢাললে 'আত্মারাম' সতেজ হয়ে একেবারে খাঁচা ছেড়ে দৌড়াতো | শরীর বড় বেয়ারা, তাকে বেশি স্বাধীনতা দিয়ে লাভ নেই | তবে আবার কম দিলেও ক্ষতি | আমি ‘ক্লাসফ্রেন্ড’ গল্পে পড়েছিলাম, ‘শরীরের নাম মহাশয়..’ আত্মার উল্লেখ ছিলোনা ওতে | তাই বীরবিক্রমে চুপিচুপি রূহ-আফজার প্রলোভন কাটিয়ে তাসকিন পৌছালাম |
তাসকিন
উর্দুতে তাসকিন মানে 'তৃপ্তি' | বলা বাহুল্য নয় যে, দোকানটি নিজের নামকরণের সার্থকতা প্রমান করতে পেরেছে - এখানে দুটি জিনিস এক অসাধারণ তৃপ্তি এনে দেয় :-
চিকেন চেঙ্গেজি - নাম শুনে মনে হলো চেঙ্গিস খানের বংশধর। যদিও দেখে বুঝলাম
জমকালো বস্তুটি আসলে, কেএফসি চিকেন-এর হারিয়ে যাওয়া সৎ-ভাই । কিছু বড় মুরগির
মাংসের টুকরোকে ভেজে, মসলা মেখে, গরম গরম পরিবেশন করা হয়। উইকিপেডিয়া ঘেটেও
এর চেয়ে বেশি তথ্য এটির ব্যাপারে জোগাড় করতে পারিনি, তাই ক্ষমাপ্রার্থী। পেটের চিন্তা আগেই
ছেড়ে দিয়েছিলাম। তাই আমি আর অর্ণব মিলে আধা-কেজি পেটে পাচার করে দিলাম।

মাহি আকবরী বা ফিশ আকবরী - বইয়ে পড়েছি, আকবর নাকি সপ্তাহে তিনদিন নিরামিষ ভোজী ছিলেন, খাবার জল হিসেবে শুধুমাত্র গঙ্গাজল পান করতেন। এছাড়া তার আসক্তি ছিল
সামোসা (সিঙ্গারার জারজ সন্তান), শাকসবজি, হালিম এবং ইয়াখনির (মাংসের স্টু) প্রতি । গঙ্গার
জলে তিনি মাছ ধরতেন কিনা এনিয়ে সালমা হোসেন এখনো কিছু লেখেননি। তাও কোথা থেকে
জানিনা, তাসকিনের লোকেরা সেই খোঁজ পেয়েছে।
মাহি আকবরী হলো একটি বিশাল কাতলা মাছের রিং পিসের ভাজা। তাসকিনের যে মাছ গুলো
ব্যবহার হয় তাদের ওজন কমপক্ষে ১০-১১ কেজি হবে। যাতে গিয়ে প্রতিটি রিং-পিস এর ওজন
দাঁড়ায় প্রায় ৫০০-৭০০ গ্রাম। ভিতরে নরম এবং বাইরে খাস্তা এই মাছ ভাজা পরিবেশন করা হয়
পেঁয়াজ ও ধনিয়া-পুদিনা চাটনির সাথে।

আমার বিশাল শখ ছিল যে তাসকিন ফালুদা খাবো | তবে আমরা যত দেরি করে পৌঁছেছি, তাতে সেগুড়ে বালি | মাছ, মাংস মিলিয়ে দুজনে মিলে প্রায় ৭০০ গ্রাম মতো খেয়েছি, তাই ঠিক করলাম ফালুদা না পাওয়ার দুঃখে, হেটে হেটে বাড়ি ফিরবো | অর্ণব লোলুপ হাঙ্গরের মতো দৃষ্টি নিয়ে বললো, "ভাই মিষ্টি খাবিনা ?" বাঙালি আর মিষ্টি, এ সম্পর্ক যুগ-যুগ ধরে চলছে | না করি, আমার বাপের সাদ্ধ কি ? তাই পা বাড়ালাম হাজি আল্লাউদিনের দিকে |
হাজি আলাউদ্দিন সুইটস
বাঙালি মাত্রই মিষ্টির রসিক | রসগোল্লা, পান্তুয়া, জিলিপি আরও কত কি | তবে হাজি আলাউদ্দিন-এর খ্যাতি এসবের জন্য না, বরং এসব পাওয়াই যায় না | জাকারিয়া গেলে আমি সব সময় এখানে আসি সব শেষে, মিষ্টি মুখ করে বাড়ি ফিরবো বলে | বড়ো দোকান আর লাল চুলওয়ালা কাকার ব্যবহার এখানে আমার মন ভরিয়ে দেয় | ওজন করা মিষ্টিতে সব সময়ই দেখি, বেশি বই কম দেননা | প্রায় আদমের দোকানেরই সমবয়সী এই মিষ্টির দোকান (আদমের কোথায় পরে আসছি) |
মাওয়া লাড্ডু (জমানো দুধ আর মিষ্টি বুন্দি দিয়ে), বত্তিসা হালুয়া, গুলাব জামুন, আমৃতি আর কাজু আফলাতুন - আমার এ কটাই খাওয়া এখানে | এদের মধ্যেও, আমার সব চেয়ে প্রিয় দুটি এদিন পেয়েছিলাম:-
বত্তিসা হালুয়া - নাম অনুসারে, এতে ৩২টি ভিন্ন উপাদান রয়েছে। হালুয়াটি গাঢ় রঙের, শক্ত,
দানাযুক্ত, স্বাদে অসাধারণ। বর্তমানে কেজি প্রতি ৬০০ টাকা করে | হাজি আলাউদ্দিন সারা বছরই
সব মিষ্টি বিক্রি করে | তবে বত্তিসা খেতে গেলে একমাত্র রমজানের সময়ই পাবেন |

গুলাব জামুন - আসল গুলাব জামুন পান্তুয়ার থেকে বেশ আলাদা, তা বোঝা যায় এই দোকানে
খেয়ে | এই জামুনে কেশর,বাদাম-এর পুর দিয়ে ভাজা হয়েছে দেশি ঘি দিয়ে | আমার ব্যক্তিগত
মতে এটি কলকাতার সেরা গুলাব জামুন |
প্রায় সাড়ে ৭ টা বাজছিলো, সন্ধ্যেও প্রায় পার | লালনশিষ্য কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের লিখে গেছেন, "ডাকি হে তোমারে । হরি দিনতো গেল সন্ধ্যা হল, পার কর আমারে !" সেদিন হরি না আল্লাহ আমাদের ডাক ঠিক কে শুনছিলেন জানি না | তবে আলাউদ্দিনের মিষ্টি আমাদের পার করে দিয়েছিলো বটে | অথএব, সেদিনের মতো গুটিগুটি পায়ে ঘরে ফিরেছিলাম |
-------------------------------------------------------------------------------
পর্ব - ৩
আজকাল খাদ্যরসিক ভালো ছেলেপুলে পাওয়া কঠিন ব্যাপার | যাই হোক, আমি বহু পুন্য করেছি | তাই অফিস-এর একটি নিতান্ত ভালো ছেলে দেবর্ষি ইচ্ছাপ্রকাশ করলো জাকারিয়া যাওয়ার, আমি এমনিতেই মনে মনে অর্ণব কে গাল পারছিলাম গতবার দেরি করে যাওয়ার জন্য আমাদের অনেক প্ল্যানন্ড খাওয়া দাওয়া মিস হয়ে যায় বলে |
১৬-ই এপ্রিল, রমজানের দ্বিতীয় সপ্তাহ
বিকেল ৪ টা ১৫ ,
সুযোগের সৎব্যবহার করে শনিবার বেরিয়ে পড়লাম দেবর্ষি কে নিয়ে | আর এখানে বেরিয়ে পড়ার মানে, ভালো ছেলেটি ঠিক বলা সময় মতো বিকেল ৪-টায় জাকারিয়া পৌঁছালেও আমি পৌছালাম ১৫ মিনিট দেরিতে | যাই হোক, এই দোষ এবং সর্বোপরি দেবর্ষিকে ভুল বসত বহুবার সপ্তর্ষি ডাকার দোষ, ক্ষীনভাষী ছেলেটি ক্ষমাঘেন্না করে দিয়ে যোগ দিল আমায় সুফিয়াতে | বরং ও গিয়ে লাইন তা রাখতেই তাড়াতাড়ি পেয়ে গেলাম খাবার |
সুফিয়া
জাকারিয়া স্ট্রিট-এর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ দোকান মনে হয় সুফিয়া | শীতকালের সকালে নিহারী হোক, কি সারাবছর সন্ধ্যেবেলার বিফ-বিরিয়ানি, সুফিয়া উভয়েই খ্যাত | তবে রমজানের সময়ে বিকেল বিকেল সুফিয়াতে ভিড় হয় অন্য একটি জিনিসের জন্য - 'হালিম' |
হালিম - হালিম জিনিসটির প্রতি আমার ছোটবেলা থেকেই অগাধ কৌতূহল | স্কুল থেকে ফেরার
পথেে পার্কসার্কাসে আর্সালানের বাইরে দেখতাম বছরে এক মাস করে অস্থায়ী কাউন্টার খুলতো,
আর ওপরে লেখা থাকতো চিকেন/মটন হালিম |
সুফিয়া মূলত খ্যাত মগজ হালিমের জন্য | যদিও আমার প্রিয় এখানকার চিকেন হালিম, এর জন্য
বন্ধুবান্ধবের কাছে কম কথা শুনতে হয় নি | মটন ছাড়া নাকি হালিম হয় না | যাই হোক, আমার
সংস্পর্শ দোষ থাকলেও আমার জিভের তা কোনোদিনই ছিল না, তাই এই নিয়ে তর্ক করা বৃথা |
হালিম আদতে, এক ধরনের স্টু যাতে গম বা বার্লি, মাংস এবং মসুর ডাল থাকে। মাংস ব্লেন্ড
করে বা ম্যাশ করে তৈরি করা হয় এবং রুটির সাথে বা একা একা গরম পরিবেশন করা হয়।
কলকাতা তথা, সুফিয়ার হালিম এ দলের আধিক্য চোখে পড়ার মতো, তাই অনেক স্থানে একে
ডালিম ও বলা হয় |

হালিমের উৎপত্তি জনপ্রিয় আরবীয় খাবার হারিস বা জারিশ থেকে। প্রথম হারিসের লিখিত
উপস্থিতি পাওয়া যায় ১০-ম শতকে। ভারতীয় উপমহাদেশে হায়দ্রাবাদ নিজামের সেনাবাহিনীর
আরব সৈন্যরা প্রথম হারিসের প্রচলন করেছিল। আজও, হায়দ্রাবাদের একাংশে, বারকাস
অঞ্চলে, যে হালিম বিক্রি হয় তাকে জারেশ বলা হয়। হায়দ্রাবাদের লোকেরা কালক্রমে তাদের
স্বাদানুসারে হারিসের পরিবর্তন করে তৈরী করেন আজকালের আধুনিক হালিম । রমজান ও
মহরম মাসে সারা বিশ্বেই হালিম একটি বিশেষ খাবার হিসেবে ইফতারের সময় খাওয়া হয় ।
তাসকিন
চিকেন চেঙ্গেজি দিয়ে সারাধনত আমি সকলকে অভিষেক করাই তাসকিন-এ, তবে চেঙ্গেজি নিয়ে আগেই লিখেছি | উপরন্তু, দেবর্ষি ক্ষীনভাষীর সাথে সাথে ক্ষীনাহারীও বটে | তাই ২৫০ গ্রামের বেশি খেতে পারেনি | যদিও এদিন ওর ওপর আরও অনেক অত্যাচার করেছিলাম | এবার আসি এবারের আসল কথায় | গতবারের মিস হয়ে যাওয়া ফালুদায় |
ফালুদা - আমি বোকা-সোকা মানুষ। ঘরে বাইরে আমার "इज़्ज़त का फालुदा" হতেই থাকে
হামেশাই। তবে আজ সেদিন নয়, আজ 'ইজ্জত সে ফালুদা খাওয়ার দিন'। তাসকিনের ফালুদা
আমার খাওয়া সেরা। তাসকিন-এ যেটা বিক্রি হয়, সেটি নুডলস দিয়ে তৈরি ঠান্ডা মিষ্টির একটি
মুঘলাই খাবারের সংস্করণ। ফালুদার উৎস খুঁজতে আমাদের ফেলুদার মতো মগজাস্ত্রের প্রয়োজন
নেই, এই যা বাঁচোয়া।
ফালুদার উৎপত্তি ফার্সি খাবার 'ফালুদেহ' থেকে। এর বহুরূপ পশ্চিম, মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে
পাওয়া যায়। ঐতিহ্যগতভাবে দুধ, গোলাপের সিরাপ, ভার্মিসেলি এবং মিষ্টি তুলসীর বীজ মিশিয়ে
তৈরি করা হয় এবং আইসক্রিমের সাথে পরিবেশন করা হয় এই পানীয়টি । ফালুদার মধ্যযুগীয়
ভারতে এসেছিল মূলত ১৬ থেকে ১৮ শতকে। ফালুদার বর্তমান রূপটি মুঘল সাম্রাজ্যে বিকশিত
হয়েছিল এবং তাদের ভারত বিজয়ের সাথে সাথে ছড়িয়ে পড়েছিল বিভিন্ন রাজ্যে ।
তাসকিন ফালুদা বিক্রি হয় মূল দোকানের পাশে রাখা একটি ফ্রিজ থেকে। একজন ব্যক্তি প্লাষ্টিক-
এর ঢাকা দেওয়া গ্লাস ২০ টাকা করে বিতরণ করেন । সারা বছরই পাওয়া যায়। তবে রমজানের
সময় খাওয়ার আমেজ-এ আলাদা।

পেটে এখনো আমার বিস্তর জায়গা বাকি ছিল | এখনো কাবাব খাওয়া হয়নি, ভেবেই মনটা আনচান করছিলো | দেবর্ষি বললো অনেক খেয়ে ফেলেছে রেস্ট চাই | ওকে ১০ মিনিটের রেস্ট দিয়েছিলাম | তারপর একটা কোল্ড-ড্রিংক কিনে পোলা আমায় যোগ দিলো কাবাবের লাইনে | লাইন-ই বটে, বড়ো-সর লাইন ছিল সেদিন আদমের দোকানে |
আদমের কাবাবের দোকান

ধরুন আপনি নাখোদা মসজিদের গেটে দাঁড়িয়ে আছেন | একটা ঢিল ছুড়ে মারুন, ৫০% চান্স আছে সেটা গিয়ে পড়বে প্লিয়ারস লেন/চুনা গলিতে | দেখবেন ছোট্ট একটি দোকানে জনা-তিনেক লোক বসে সুতোয় মালা গাঁথছে, তবে ফুল দিয়ে না - মাংস দিয়ে | না না ফাজিল কথা কইছি না, মাংসের মালাই গাঁথা হয় এখানে | দোকানটির নাম আদমের কাবাব, দোকানটির বৈশিষ্ট - সুতলি কাবাব ও বটি কাবাব | আজ এখানে মাত্র একশো তাকে দুজন মন ভরে কাবাব খেতে পারে | সুতো টাকে বের করে নিতে ভুলবেন না | দোকানের মাথায় দেখবেন লেখা আছে এটি ১০৫ বছরের পুরানো |
১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত, এই দোকানটি শুরু করেন শুভনী মিয়া, এবং নামকরণ করেন তার ছেলে আদমের নামে । বর্তমানে এটি পরিচালনা করছেন আদমের ছেলে সালাহউদ্দিন।
সুতলি কাবাব - মাংসের সূক্ষ্ম টুকরোগুলোকে একটি সুতোর সাহায্যে একত্রে বেঁধে, উচ্চ
তাপমাত্রায় গ্রিল করে তৈরী হয় মশলাদার ও মুচমুচে সুতলি কাবাব |

বটি কাবাব - মাংসের টুকরো (মাটন, মুরগি বা গরু) কে দই, রসুন, আদা, মরিচ এবং মশলা
মিশিয়ে ম্যারিনেট করে, নিখুঁতভাবে গ্রিল করে পরিবেশন করে এখানে |
আরও কয়েকধরণের কাবাব পাওয়া গেলেও এখানে আমার এ দুটিই প্রিয় | যাইহোক এবার ছিল পরম্পরার কথা | এযাত্রার 'মধুরেণ সমাপয়েৎ' করতে বাকি ছিল মিষ্টি খাওয়া | অথএব, আগামী গন্তব্য ফের হাজি আলাউদ্দিন |
হাজি আলাউদ্দিন সুইটস
মোটামুটি পাশাপাশি এবং সমবয়সী হলেও আয়তন তথা আয়োজনে আলাউদ্দিন ও আদমের মেল পাওয়া দুস্কর | গতবার একটি কথা লিখতে ভুলেছিলাম, কলকাতায় বেশিরভাগ মিষ্টির দোকানে মিষ্টি বানানোর প্রবণতা ছানা-কেন্দ্রিক, তবে হাজী আলাউদ্দিনের কিছু মিষ্টি সেইদিক থেকে বেশ অনন্য |বত্তিসা হালুয়া, গুলাব জামুন নিয়ে আগেই লিখেছি, আমি প্রতিবার এখানে গেলেই খাই | তবে এবার আরেকটি জিনিস প্রথম খেলাম - 'কাজু আফলাতুন' |
ছোটবেলায় অক্ষয় কুমারের ভক্ত ছিলুম | যতদিন তিনি আত্মা বেঁচে, পলিটিকাল দালালি না শুরু করেছেন, ততদিন বড়বেলায়ও তার ভক্ত থেকেছি | তারই একটি সিনেমা ছিল ৯০-এর দশকে 'আফলাতুন' | খেপা নাচ, খেপা ভঙ্গিমা - আর যাই হোক কথাটার মধ্যে খ্যাপামো লুকানো আছে এটুকু নিশ্চিত ছিলাম |
কাজু আফলাতুন - দার্শনিক প্লেটোকে আরবে বলা হতো আফলাতুন, এর অর্থ চৌকস তবে
আড়ম্বরহীন, উদ্ভট এক ব্যক্তি/বস্তু | নামটি বেশ উপযুক্ত কাজু অফলাতুনের জন্য, কারণ এটি
স্বাদ, সুগন্ধ এবং টেক্সচারের একটি রোলার কোস্টার (উদ্ভট) সংমিশ্রণ । শুরুতে ঘি এর গন্ধ এবং
উষ্ণতা অনুভব করে, ক্রমশ আসে ক্যারামলাইজড কাজু এবং মাওয়ার একটি খুব মোটা
টেক্সচার | যার সাথে মিশে থাকে বিভিন্ন শুকনো ফলের স্তর।

দেবার্ষির ঘর সংসার ছিল, আজও আছে | আমার নেই, অথএব ওর তাড়া ছিল, মিষ্টি খাওয়া হয়ে গেছে, আমার আরও অনেক জ্ঞান কপচানো বাকি ছিল | তবে, সেদিনের মতো ইতি টানতে হলো |
-------------------------------------------------------------------------------
২০২৩
-------------------------------------------------------------------------------
পর্ব - ৪
আরেকবছর পার হলো, আমার জীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি, আমার আশেপাশের সব ছেলে-ছোকরা পাল্টে গেছে | সুদীপ্ত এখন পুরোদস্তুর সংসারী, ওর খোঁজ পাওয়া বিরল | অর্ণব হাবু-ডুবু খাচ্ছে , কিসে সেটা আর বলছি না | আসা করি সবাই বুঝে গেছে | দেবর্ষিও আমার সাথে এতো কিছু ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান-এ হ্যাঁ-হ্যাঁ বলে, চুপি চুপি ওদিকে নিজের তাজমহল বানানোর স্পন্সরশিপ খুঁজে বেরিয়েছে | মোদ্দা কথা হলো আজকাল সরল, ব্যাচেলর, খাওয়া দাওয়া লোভী ছেলের অভাব | হালফিলে আমার কিছু ভুল সুখ্যাতি ছড়িয়েছে, জাকারিয়া নিয়ে | সেই সুখ্যাতিকে সম্বল করে, তাই আমি ভাবলাম একটা বিবাহিত ব্যাচেলরকে টার্গেট করবো |
আমার এক্স-এক্স ম্যানেজার অর্পণ দা, সকলের পেয়ারের 'পাগলা দা' | ভবাপাগলার মতোই আত্মহারা মানুষ | বৌদিকে বাইপাস করতে হয়নি, গত বছর থেকেই ভদ্রলোককে নিয়ে যাই নি বলে, অকাতরে গাল পারছিলেন | এবার এমনিতেই সুযোগ পাচ্ছিলাম না, বা সুযোগ পেলে লোক পাচ্ছিলাম না | তাই যখন রমজানের শেষ সপ্তাহ এসে গেলো, অগত্যা একদিন অফিস থেকে মিটিং কাটিয়ে পাগলা দাকে নিয়ে বেরুলাম জাকারিয়ার দিকে | বেরুতে বেরুতে প্রায় ৪তে বেজে গেছিলো | তাই সব খাওয়া পাওয়ার আসা কম ছিল | ভদ্রলোক মিষ্টির উপাসক | তাই ভাবলাম ৭ টা অবধি আলাউদ্দিন আছে, বৃথা ফিরবেন না |
২০-এ এপ্রিল ২০২৩, রমজানের শেষ সপ্তাহ
বিকেল ৫ টা ৩০ ,
কলকাতা আজকাল রাজস্থানের থেকেও বেশি গরম | উষ্ণতাও নাভিশ্বাস উঠছে | জাকারিয়া পৌঁছাতে গিয়ে আমরা দুজন ঘেমে স্নান করে গেলুম | তবে পাগলা দা অমায়িক মানুষ, ঘাম-তামের ধার ধরেন না, খাবার জন্য সব কষ্ট ভুলতে পারেন | অথএব জুটিটা ভালোই ছিল |
প্রথমে গিয়ে পড়লাম আবার সেই তাসকিন-এ | তাসকিনের চেঙ্গেজির লাইন দিতে গিয়ে আমাদের আধ ঘন্টা বেরিয়ে গেলো, আফসোস রয়ে গেলো ফালুদা নিয়ে, এদিন শেষ হয়ে গেছিলো | দোকানদার মহাশয় আমাকে লস্যি চাপানোর চেষ্টা করেছিলেন, তবে আমি সেপথে পা বাড়াই নি | লস্যি খেতে কলকাতা হলে আমি বলবন্ত-সিংহ এর ধাবায় যাবো, এতো পথ ঠেলে এসে ফালুদাই খাবো, নাহয় কিছু না | আর দুঃখী হলাম সেদিনের মাহি আকবরীর পিস্ গুলো দেখে, খুবই ছোট | বড়ো মাছ ধরা পড়েনি বোধহয় |

ফালুদাটা নিয়ে মন খুঁতখুঁত করছিলো | তাসকিনের ফালুদা ৩০ টাকা গ্লাস | তাই উড়ে যায় ফুড়ুৎ করে | তবে জাকারিয়া এসে ফালুদা খাবো না ! তাই সেদিন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে, ঢুকলাম দিল্লি-৬ এ, শুধু ফালুদার জন্য | অন্য কিছু চাইতে যাবো, দোকারদের বললেন আমাদের ইফতারির সময় হয়েছে, এখন ৩০ মিনিট কিছু পরিবেশন হবে না, অগত্যা |
মিষ্টির উপাসককে তার মন্দিরে নিয়ে যাওয়ার আগে ইফতারির সময় কাটাতে গিয়ে দাঁড়ালাম নাখোদা মসজিদের সামনে | নাখোদা নিয়ে বলতে গেলে আরও ১০০০ লাইন লিখে ফেলবো, তাই আজ সেপ্রসঙ্গ থাকে | সময় হয়ে এসেছিলো এবার হাজি আলাউদ্দিন যাওয়ার |
হাজি আলাউদ্দিন আর লালচুলাওয়ালা কাকা আমার কাছে সমার্থক | ১০০ গ্রাম করে বত্তিসা আর ২টো করে গুলাব জামুন, কাকা দিয়ে দিলেন আমাদের | খেয়ে পাগলা দা বললো, আরও ২টো করে জামুন দিতে বল | সেদিন আমৃতি দেখলাম না, পেলে ঘরে আনার ইচ্ছা ছিল |
বাড়ি ফিরবো ভাবছিলাম, তবে পাগলা দা আজ্ঞা দিলো - এস্প্লানেডে যেতে হবে | বেলুন আর টুপি কিনতে দুদিন পর ছেলের জন্মদিন | গুগল ম্যাপ খুলে ডাইরেকশন দিয়ে হাটতে শুরু করলাম | সেদিন বাড়ি ফিরতে রাট ৮টা ১৫ বেজেছিল |
-------------------------------------------------------------------------------
পর্ব - ৫
আগেই বলেছি, জাকারিয়া গিয়ে গিয়ে নাম কামিয়েছি। নামের ঠেলায় গাল ও কম খাচ্ছি না, কাউকে নিয়ে যাওয়া বাদ গেলে। এবছরের মতো শেষ পালা শুভঙ্কর দার, তাও আবার সেই ঈদের দিনেই।
২০২১-এর অভিজ্ঞতা থেকে আমি এবার আগে থেকেই বলেছি, সাড়ে ৩ টের মধ্যে জাকারিয়া পৌঁছাতে। শুভঙ্কর দা এলো ৪.১৫ এ। বলা বাহুল্য, এটাই আমার আশা ছিল, তাই সাড়ে ৩ টে বলা।
২২-এ এপ্রিল ২০২৩, আরেকখানি ঈদ-উল-ফিতর
বিকেল ৪ টা ১৫ ,
আমার মনে হয়েছিল আজ বেশিকিছু খোলা থাকবে না। তবে, তিন বছরে দুনিয়া তথা জাকারিয়া পাল্টেছে। রাস্তার ধারের অস্থায়ী দোকান গুলো উঠে গেলেও, স্থায়ী দোকান সব ছিল খোলা আর ভিড়ে ভিড়। শুরু করলাম তাসকিনের চেঙ্গেজি দিয়ে, সাথে ছিল ফালুদা। এরপর দিল্লি-৬ ঢোকার আগে ঘুরে এলাম আদম-এ, আজ বন্ধ। তারপর প্রায় ৪০ মিনিট কাটালাম নাখোদা মসজিদ-এ । এক নতুন জিনিস জানলাম। ২৫-শ ডিসেম্বর এর গির্জার মতোই, আজ নাখোদায় সবার অবাধ প্রবেশ, সর্বস্তরে।
দিল্লি-৬
অবশেষে এলো দিল্লি-৬ এর পালা। শেষ চিকেন আফগানী খেয়েছিলাম সেই ২০২১-এ, ঘর থেকে ঠিক করেই বেরিয়েছিলাম আজ পেলে ছাড়বো না। সাথে নিলাম আমার উইশ-লিস্ট-এ শেষ বাদ থেকে যাওয়া ড্রাই-ফ্রুট শিরমল।
শিরমল - শিরমল এসেছে ফার্সি শব্দদ্বয় 'শির' যার অর্থ 'দুধ' এবং 'মালিদান' অর্থ 'মাখা' থেকে।
আক্ষরিক অনুবাদে, শিরমল মানে দুধ মাখা। পারস্যে উদ্ভূত, এটি মধ্যযুগীয় সময়ে মুঘল
সম্রাটদের দ্বারা উত্তর ভারতে প্রচলিত হয়েছিল।

শিরমল আদতে একটি মৃদু মিষ্টি নান। যা ময়দা দিয়ে তৈরি, ইস্ট দিয়ে ফাঁপানো ও তন্দুরে বেক
করা । নানের রেসিপিতে উষ্ণ জলের পরিবর্তে চিনি মিশানো উষ্ণ দুধ ব্যবহার করে, জাফরান ও
এলাচ যোগে স্বাদ দেওয়া হয়।
সেদিন মানে 'আজ' শেষ করলাম হাজি-উদ্দিনের গুলাব জামুন দিয়ে। কিছু পরম্পরা আমি মেনে চলি বটে, যদিও তারা সবই খাওয়া-দাওয়া বিষয়ক।
এই হলো গিয়ে আমার ঈদ-টু-ঈদ তিন বছরের জাকারিয়া খাদ্য ভ্রমণের ফিরিস্তি। আরো বহু ঈদ আসবে যাবে, আরো বহু বার জাকারিয়া আসব হয়তো। অথবা আর হয়তো আসা হবে না। সময় ও সমাজ উভয়ই পাল্টাচ্ছে। বয়সও হচ্ছে । ভাগ্য ভালো, লোভ কমছে না, আর কেউ না কেউ খাদ্যসাথী জুটে যাচ্ছে ঠিক। তাই ভবিষ্যৎ আল্লাহ বা ভগবানের ওপর ছেড়ে দিয়ে আমি আজকের মতো শুতে যাচ্ছি। লাস্ট-এ বলে যাই সেই অমোঘ তিনটি শব্দ - "জশন-এ জাকারিয়া জিন্দাবাদ !!!"
References:
Wikipedia.
Personal experience.
Bhai osadharon likhechis. Tor ei food-pedition e ami part chilam bhebei moja lagche. Asche bochor asha kori ami abar jurbo, obossoi dujone mile. Dekha jaak tor ki poristhiti thake.