|| ছাতা-কাহিনী ||
- nitishb
- Jul 7, 2018
- 5 min read
Updated: Jan 23, 2022
Disclaimer:গল্পের সাথে বাস্তবের যথেষ্ট মিল আছে | কোনো ব্যক্তিবিশেষ/ঘটনার সাথে সাদৃশ্য পাওয়া অবশ্যই অস্বাভাবিক নয় | কতটা বিশ্বাস করবেন তা আপনার ওপর | অনেক কিছু আমার সাথে ঘটে থাকে, যা লোকে মানতে চায় না | শুধু একটা অনুরোধ,মনে রাখবেন, 'ক্ষমা একটি মানবিক গুন ' | ☹

'জল পড়ে, পাতা নড়ে'
ভিজে, জ্বরে মাথা ঘোরে
ওরে ছাতা, ভুলি তোকে
শুধু কেন , জানিনারে' ||
"ছাতাটা তো তোর মনে হয়না", ভদ্রমহিলা বললেন |
"না মানে আমারি তো, মানে, ঘর থেকে আনা", উত্তর দিলাম |
"মিথ্যে বলিস না , গোলাপি রঙের ছাতা তোর? অন্য লোকের জিনিস না বলে নেওয়াকে কি বলে জানিস? স্কুলে গিয়ে এই শিখেছিস? দাড়া হচ্ছে তোর |"
গুছিয়ে কেস খেয়ে গিয়েছিলাম সেদিন | অযথাই | না বলে নিইনি সত্যই, তবে ছাতাটা সত্যিই আমার ছিল না |
শুরু থেকেই বলি তাহলে | ছাতা আর আমি ঠিক কোনোদিনই 'SYMPATICO' হইনি | ও হারাতে চায়, আমিও খুব একটা বাঁধা দিইনা | আসলে আমার ছাতাগুলো বড়োই রসিক মেজাজের হয় | কেউ বাস/ট্রেনে দুনিয়াটা ঘুরে নিতে চায় | কেউ হোটেল-এ বসে খাবার দেখতে ভালোবাসে, আমিও আবদারে সাই দি | এই আর কি | এটাই মোটামুটি আমাদের পারস্পরিক বোঝাপড়া | ছোটবেলা থেকেই চলছে, স্কুল জীবনের প্রথম দিকে মা ভুল-ত্রূটি ভেবে ক্ষমা করে দিতো | কালক্রমে, সেই ক্ষমা বিরক্তিতে এবং ক্রমশ রাগে পাল্টে যায় | পরিণতি – বৃষ্টি এলে আমাকে একটা স্পোক-ভাঙা ছাতা দেয়া হতো(ক্লাস ৮/৯ হবে মনে হয়) | ধরেই নেওয়া হয়েছিল, হারাবেই যখন খরচাটা অন্তত কমানো যাক, ভাঙা ছাতাকে দীর্ঘায়ু করে!! ☹
মাঝেমাঝে, যখন আমার মাথায় বিদ্রোহী NEURON-গুলো খেপে উঠে, তখন আমি কিছুকিছু বিতর্কিত ঘটনা ঘটিয়ে থাকি | যেমন একবার : ঈশ্বরের প্রতি অগাধ আস্থা রেখে ঠিক করলাম – "মা কালির দিব্ব্যি, এই নতুন ছাতাটা না ভাঙা অবধি, আমি কিছুতেই হারাতে দেবনা’| মাস তিনেক (বা বড়োজোর চারেক হবে) আমি আর ছাতা, নিজেদের কড়া শাসনে রেখে , একসাথে কাটালাম | তবে আখেরে লাভ হলো না | কারণ একে আমি দয়ালু, তার ওপর - ছাতাটি মহাব্যভিচারী, যতই বলি ‘যেতে নাহি দিবো’, তাও ‘যেতে দিতে হলো’| বুদ্ধিমান লেখক এখানে একটা জমাটে পৌরাণিক উপমা যোগাতো বোধহয়, তবে ছাতার ব্যাপারে লিখতে বা ভাবতে বসলে, আমার বুদ্ধি লোপ পায়, অগত্যা…
কলকাতায় গ্রীস্মকালে কালবৈশাখী আসে, বৃষ্টি হয় ; বর্ষাকালে কাল বলে বৃষ্টি হয়, পুজোর সময় (শরৎকাল) আমাদের ভোগাতে বৃষ্টি হয়, এখন তো দেখি শীতকালেও বৃষ্টি হয় | মোদ্দাকথা, কালের দোহাই দিয়ে লাভ নেই; বৃষ্টি হবেই | আর এদিকে আমি ছাতা-হারুয়া (শব্দটির একমাত্র অস্তিত্ব নিতান্তই আমার মাথায় হলেও হতে পারে) | একবার আমি, প্রচলিত প্রথার বিরুধ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ছাতা ছাড়া স্কুল-এ যাওয়া ধরেছিলাম | একদিন ভিজে ঘরে ফিরি, মা পেটায়, বিদ্রোহের ‘ইতি গজ’|
পরের অংশটা পড়ার আগে, মনে একটু দয়া-মায়া রাখবেন| মানে, স্বভাবে নাহলেও, অভাবে মানুষ কতই কিনা করে থাকে | যাহোক, আমার মাথায় একবার এক নতুন বুদ্ধি এলো, টিভি-তে সেদিন শুনলাম ট্রেনে-ট্রেনে সংঘর্ষ হয়েছে | উদ্ধার কাজে সেনা মোতায়েন |
ঠিক করে ফেললাম আমিও উদ্ধারকর্মী হবো | ছাতা উদ্ধার করবো | তা কিভাবে? কেন, মানে আমি এক এবং একমাত্র মানুষ নই, যে ছাতা হারায়, আরও অনেকে আছে,ছিল ও থাকবে | তাই এরকম আমার সমগোত্রীয়রা যখন ছাতা হারিয়ে ফেলবে, আমি সময় সুযোগ পেলে সেগুলোকে উদ্ধার করবো, এই আর কি |
প্রকল্পটা নিয়ে সবে ভাবনা চিন্তা করছি ,হঠাৎ, একদিন একটা বাসে উঠলাম শিয়ালদাহ থেকে | মিনিট ২০ পরে যেই নাকি বাড়ির কাছের বাইপাস-কানেক্টরে নামবো, সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে যেন মনে হলো আমি যেখানে বসেছিলাম তার ঠিক উল্টোদিকের সিটে যেন একটা ছাতা দেখলাম | মালিকহীন একা, ব্যভিচারী এক ছাতা | আরও ৫ মিনিট পরেই বাস বাইপাস পৌঁছাবে | আমার মধ্যে কর্তব্যবোধ জেগে উঠলো, ওই ছাতাটাকে উদ্ধার করা উচিত, বেচারা একা একা কষ্ট পাচ্ছে | এদিকে আমি রাস্তায় পা দিয়ে ফেলেছি, আর বাস ছেড়ে দিয়েছে | দোনামোনা করতে করতে, আমি দিলাম ছুট, বাসটাকে ধরতেই হবে | ছাতাটা কাঁদছে, আমি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি |
কেউ যখন ছাতা হারায়, সে চিরতরেই হারায় | ভেবে দেখুন, নিশ্চই এটা কোনো-না-কোনো পূরণে লেখা আছে | আমার মনে হয় আমাদের সবার এবিষয়ে একমত হওয়া উচিত যে, ছাতা উদ্ধার করা খুব একটা ধার্মিক কাজ না হলেও নিতান্ত নিন্দনীয় কাজ মোটেই নয়,যদিও পরে বুঝেছিলাম ব্যাপারটা অতটা সাদামাটা নয়, খানিকটা 'GREY AREA' আছে |
আমিতো ছুটছি বাসের পিছুপিছু | ২০-৩০ সেকেন্ড পরে একটি ছেলে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলো দেখে তাকে বলে-কয়ে তার CYCLE CARRIER-এ বসে পড়লুম, এবং দুজনে তারস্বরে বাস কন্ডাকটর-এর উদেশ্যে হাঁকডাক শুরু করলাম | এখানে বলে রাখি, উদ্ধারের ধারণাটির ব্যাপারে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা কতটা, সে নিয়ে মনে কিছু সন্দেহ ছিল | তাই ছেলেটি জানতো ছাতাটি আমারই (এটাই সেই আগে উল্লেখিত GREY AREA)| যাইহোক, মিনিট খানেকের মধ্যেই বাস কন্ডাকটর আমাদের ডাকে ঘন্টি বাজিয়ে বাস থামালো | আমিও বীর-পরাক্রমে, পুরুষোচিত গর্বে বাসে উঠে পড়লাম ছাতা উদ্ধার করতে |
ঠিকই শুনেছিলাম আমি, ছাতাটি কাঁদছিলো, ঝামেলা হলো সে কান্নায় নাক-টান ছিল বড় বেশি, ছিঁচকাঁদুনে ছোটোলোক ছাতা | ছাতাটি আমায় ধোঁকা দিলো, তার ডাটি দেখছিলাম আমি, রং দেখতে পাইনি বোধহয়, উহা গোলাপি | কাটিয়ে দেব যে, তা আর সম্ভব ছিলনা, বীরদর্পে উঠেছি বাসে সবাই তেড়ে-তেড়ে দেখছিলো | তাই ছত্রানি-খানি (আরেকটি শব্দ, যেটি সম্ভবত শুধু আমার মাথার শব্দকোষেই আছে, তবে মনে হয় মানেটা স্বঘোষিত) বগলদাবা করে বাস থেকে নামতে হলো | সাইকেলচালক ছেলেটি যে ঠিক কিছুক্ষন আগেই আমার সহমর্মী হিসাবে গলা ফাটাচ্ছিলো, তার মুখে হঠাৎ যেন এক চিলতে ফিচকে হাসি দেখলাম, তবে বিপদ আর না বাড়াতে,তাকে বেশি পাত্তা দিলাম না, উল্টো দিকে হাঁটা লাগলাম | ১০ পা-ও যাইনি ধরলেন এক ভদ্রমহিলা | এতক্ষনে, নিশ্চই আপনারা গল্পের শুরুটা ভুলে গেছেন তাই আরেকবার শর্ট-এ বলি,- “ছাতাটাতো তোর মনে হয়না”, বললেন সেই ভদ্রমহিলা |

যতই তিনি জোর দেন যে, ও ছাতা আমার নয়, আমিও মিনমিনে গলায় তর্ক চালাতে থাকি, 'না মানে,এটা আমার দিদির ছাতা, আজ আমি এনেছি, আমারটা সরানো হচ্ছে বলে' | মনে মনে এদিকে তখন আমি ছাতার চোদ্দ-গুষ্টি উদ্ধার করছি, 'আর শালা কোনোদিন গোলাপি ছাতা উদ্ধার করবো না | ছিড়িছাড়া নাঁকে কান্না তোদের, উচ্ছনে যা| ততক্ষনে অযাচিত দেড়-সেয়ানা ভদ্রমহিলা, আরো সাহসী হয়ে উঠেছেন | এতক্ষন তর্ক ছিল যে ছাতাটা আমার কিনা, এবার থেকে তিনি বলে বসলেন - ও ছাতা তার | প্রমান - 'আমার ছাতায় নাম লেখা থাকে, সেলাই করে |' হঠাৎ আমি দূরের আওয়াজ শুনতে পেলাম, ভগবান ডাকছে, আর এ সংসারে থেকে কাজ নেই, হিমালয়ে যাই বরং |
এ চিন্তাধারার দুটো কারণ ছিল | এক - সামনেই বাড়ি, চেনা কেউ এ বচসায় কান পাতলে, আমার মহান উদ্ধারকর্মের কথা মায়ের কানে উঠবে | ব্যাস, আমার জীবন মানে ZEE BANGLA হতে আর বেশিদিন রইলো না | তাও আবার সবে শুরু উদ্ধারকাজের জন্য, এখনো যার একটাও সফল হয়নি| দুই - আমি প্রায় মেনে নিয়েছিলাম,ছাতাটি উটকো-মহিলারই | কারণ, আমার 'ভালো ছাতা হারানোর যুগে' অতিরিক্ত সতর্কতা দেখতে আমার মাও আমার নাম সুতো-সহযোগে ছাতার ধারে খোদাই করে দিতো | দেশে-দেশে, ঘরে-ঘরেকোন যোগাযোগ পথে খবর যেত জানিনা (তখন-তো ফোন এর স্মার্ট হয়ে ওঠেনি), সব মা-ই একই ষড়যন্ত্রে নাম লেখাতো কেমনে তবে | এই অনাচারের একটা বিহিত হওয়া দরকার |
আর কিছু করার ছিলনা | ছাতাটি মহিলার হাতে তুলে দিলাম | রাস্তায় কয়েকটা লোক, উঁকি দিচ্ছিলো ইতিমধ্যে | মহিলা এক বিজয়ীর হাসি দিয়ে নিজের নামটা ছাতার গায়ে আমায় দেখাতে গেলেন, এবার আমার পালা |
অনেক-বার দিব্ব্যি খেয়েছিলাম সেদিন, তাই হয়তো ভগবানে একটু EMOTION-এ গলে গেছিলো | মায়া মামী অনতিদূরেই দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষন, ব্যাপারটা ঠিক ঠাহর করতে পারেনি | আমার পাড়াতুতো মামী, তাঁর মধ্যে একটা বিপত্তারিণী গোছের ব্যাপার আছে | সেদিন-ই প্রথম লক্ষ করেছিলাম | মামী বেগতিক দেখে এগিয়ে এলো |
নাম দেখাতে পারেননি ভদ্রমহিলা, তিনিও বোধহয় আমারি মতো এক ছাতা উদ্ধারকরি ! থুড়ি, উদ্ধারকারিনী | সেই ধাঁধার আর সমাধান করিনি, তবে সে যুদ্ধে জয়ী হলাম আমি | মামী ঝাঁপিয়ে পড়লেন, 'বাচ্চাছেলেটা কে নিয়ে, বলি হচ্ছেটা কি? ওর ছাতা নিয়ে টানাটানি করছেন কেন?' |

এইফাকে বলে রাখি লোকে বলে, চিরকালই আমার নাকি নিতান্ত নিষ্পাপ একখানা মুখ | মার্কেট- এ এর কোনো দাম না থাকলেও , বিপদে-আপদে মাঝেমাঝে এটা কাজে দেয় |
কাচুমাচু মুখে ভদ্রমহিলা আমার হাতে ছাতাটা তুলে দিয়ে, মোটামুটি ক্ষমা চেয়ে হাটা লাগলেন | মামীকে বলেছিলাম - 'কি অন্যায় দেখো, স্কুলের এক বন্ধুর মায়ের ছাতা | তিনি ভালো বুঝে দিলেন বৃষ্টি হতে পারে দেখে | এদিকে উনি কাড়াকাড়ি করছিলেন |'
সমাজে বাচ্চাদের বহু বিপদ , তা সে 'ছেলেধরা'ই হোক আর বোমাবাজিও হোক - সবকিছু নিয়ে একটা মোটামুটি GIST মামী আমায় মিনিট ৫-একের মধ্যে বুঝিয়ে দিলো | আমিও মনেমনে রামনাম নিতে নিতে ঘাড় নাড়াতে থাকলাম |
সেদিন বাড়ি ফিরতে-ফিরতে একটা ছোট্ট জলা গলির মুখে, চারপাশে তাকিয়ে ছাতাটা গলিয়ে দিয়েছিলাম | মনেমনে সেদিনের শেষ দিব্ব্যিটা খেয়েছিলাম, "রক্ষক হয়ে কাজ নেই আমার, আমি ভক্ষক-ই ঠিক | চুলোয় যাক গোটা ছাতার সমাজ , এবার থেকে আমি
RAINCOAT-এ মন দেব" ||

Comments