top of page

বিশ্বাসে মিলায় বস্তু?

  • Writer: nitishb
    nitishb
  • Apr 18, 2021
  • 11 min read

Updated: Apr 13, 2022

বাংলার গাজন : কৃষ্ণদেবপুর, পূর্ব-বর্ধমান

- "উঠে দাঁড়া চল, ধুলো উড়ছে";

- "আর দাঁড়াতে বলিস না ভাই, আমি জেগে আছি, তবে শরীর ঘুমিয়ে পড়েছে" |

রাত তখন ২ টো বেজে ২০ মিনিট হবে বোধ হয় | কালীমন্দিরের পাশে, ছোট মাঠটাতে গত প্রায় সাড়ে-পাঁচ ঘন্টা ধরে বসে বসে আমাদের কোমর ও পা অসাড় | সুদীপ্তর হাত দুটোও ক্যামেরা ধরে ধরে ব্যাথা, সেই সকাল ৫-টায় উঠেছি | নিদ্রাহীন দিনটির ২১-তম ঘন্টা চলছে, এখনো ঘন্টা দুয়েক বাকি |


১৩-ইএপ্রিল ২০২১,


সকাল '৯:০৫' ,


অর্ণব জানালো কাল নাও যেতে পারে | ঘরে ডুয়াল-কোরোনার প্রকোপ, দাদা আর জেঠিমার, স্বাভাবিকভাবেই সবাই চিন্তাশীল | ওকে আর জোর করতে পারলাম না, এদিকে কালনা যাওয়ার ইচ্ছাটা আমার ছিল প্রবল | এবছর যাবোই, অতিমারীর কাছে রোজ আমরা হারছিই, তবে মাঝে মাঝে ঘুরে দাঁড়াতে হবে | আর পারা যাচ্ছে না | অফিসে জানানোই ছিল আজ আমি 'টেনটিটিভ', সুদীপ্ত এককথায় রাজি | পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে,আজই দুপুর ২:৩০-এর কাটোয়া লোকাল ধরবো বলে ঠিক করলাম | নাম সর্বস্ব জিনিস গুছিয়ে নিলাম চট করে |


বছর তিনেক হলো, আমি বাংলার লৌকিক দেবতা নিয়ে হঠাৎ আগ্রহী হয়ে পড়েছি | ছোটবেলায় পাড়ায় কিছু জেঠিমাদের দেখতাম নীল-এর উপোষ রাখতে, কেউ বা করতো ইতুপুজো | বাইরে বেরালে রাস্তায় এক ঝাঁক কুলো-ধারিণী মহিলার দল আধো-আধো হিন্দিমিশ্রিত বাংলায় খুচরো কিছু টাকা ভিক্ষা করতো মনসা পূজার উপলক্ষে | বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়তে গিয়ে পেয়েছি মঙ্গলকাব্যের সন্ধান, কৌতুহল আরোও বেড়েছে | জীবনটা বহুকাল বইয়ের পোকা হয়ে কাটিয়েছি, অবশেষে বয়সকালে চাকরিসূত্রে প্রাপ্ত আর্থিক সাচ্ছন্দ ব্যবহারিক জ্ঞান আহরণে উৎসাহ জুটিয়েছে | আজ তারই যোগান দিতে ছুটবো কৃষ্ণদেবপুর, গাজনের মেলায় সামিল হতে |


দুপুর '৩:৩০',


ঠিক সময় মতো হলে, ৪:১০ নাগাদ অম্বিকা কালনা স্টেশন পৌছাবো, তারপর লক্ষ্য রাত কাটানোর হোটেল খোজা, এবং তারপর বেরিয়ে পড়বো গাজনের মেলার সন্ধানে | সুদীপ্ত ক্যামেরা চেক করছে, সব ঠিকঠাক থাকতে হবে, ওর ওপর গুরুদায়িত্ব ছবি ও ভিডিও গ্রাফির |

ছোটবেলায় চৈত্রের শেষের দিকে প্রায় রোজ দুপুরবেলায়, জানলা দিয়ে আওয়াজ পেতাম 'বাবা তারক নাথের চরণে সেবা লাগে.....মহাদে---ব' | উঁকি মেরে স্বাগ্রহে দেখতাম - পরনে গেরুয়া রঙের ধুতি, গেঞ্জি ও উড়নি; হাতে থালা, কাঁধে গেরুয়া ঝোলাওয়ালা সন্ন্যাসী ৷ তখন কৌতুক লাগতো, কিছুটা ভয়ও পেতাম তাদের আলু-ঝালু চুল দেখে | তিন থেকে আট বিভিন্ন মাপের দল আসতো পাড়ায় পাড়ায় ভিক্ষে করতে ৷ গৃহস্থের বাড়ি চাল, আলু, পয়সা নিতো তারা ঝোলায় ৷ বহুকাল হলো কংক্রিটের জঙ্গলে শেয়ালরাজা হয়েছি | আজ আর শহর বাংলায় সে রব শুনিনা, গাজন বা চড়কের সন্ন্যাসীও আর দেখি না |


খামারগাছি থেকে জিরাট, ৭.৫ কিমি পথ যেতে, ট্রেন-এর লাগলো ৬৫ মিনিট | ভোটের বাজারেও ইস্টার্ন রেলওয়ে তার মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখেছে দেখে আশ্চর্য হলাম | কালনা বাসস্ট্যান্ড-এর ধারে হোটেল খুঁজে দরদাম করে উঠতে সন্ধ্যে ৬টা বেজে গেলো |


সন্ধ্যে '৭:০৫',


হোটেলে বলেছিলো ৮-টায় গাজনের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে | 'তাড়াতাড়ি অটো ধরে পৌঁছে যান, না হলে বসবার জায়গা পাওয়া দুস্কর হবে |' বাড়ির পাশের মাঠের 'শিশির বিন্দু' টি নিয়ে আমিও কম উদাসীন নই | অন্যকে আর কি দোষ দেব | সময়জ্ঞানের আমাদের বড়োই অভাব |


অটো ধরে ১০-টাকা ভাড়ার বিনিময়ে আমি আর সুদীপ্ত কৃষ্ণদেবপুরের দিকে পারি দিলাম | অটো চালক জানালো তার গ্রামেরই মেলা, তার বাড়ি পাশেই | অম্বিকা কালনার পরবর্তী স্টেশন বাঘনাপাড়া, তারপর ধাত্রীগ্রাম | দুটি স্থানেই হোটেল গোছের কিছু এখনো নেই | তাই কালনায় থেকে অটো করে যেতে হয় | বাঘনাপাড়া ও ধাত্রীগ্রামের মাঝামাঝি কৃষ্ণদেবপুর হাইস্কুল, তার একটুপরেই অটোচালক আমাদের নামিয়ে দিলো - একবার পথ ভুল করে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে | গলিপথে মিনিট তিনেক হেঁটে গিয়ে পড়লাম ছোট্ট এক মাঠে | জায়গাটার নাম কালিতলা - বামধারে, কালীমন্দির | সেখানে লাল পোশাক পড়া একাধিক বিভিন্ন বয়সের লোক বসে কিসব গোছগাছ করছে, দেখে মনে হলো পুজোর প্রস্তুতি, ছড়ানো ছিটানো আইস-ক্রিম, রোল, ফুচকার দোকান, গমগম রবে নব্বই দশকের গান চলছে | গাজনের নাম-গন্ধ নেই | এই কি সেই বিশ্ববিখ্যাত মেলা ? যার জন্য অতিমারীর বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে ঘর ছাড়লাম !! হায় 'মহাদেব' তোমার 'চরণে' আমাদের 'সেবা' কি লাগবে না?


উইকিপেডিয়া বলে সন্ন্যাসীর 'গর্জন' হতে নাকি 'গাজন', আবার এও বলে 'গাজন' নাকি আসলে 'গা' মানে গ্রামের 'জন' মানে লোকজনের উৎসব | মানে দাঁড়ায় গিয়ে - উইকিপেডিয়া জানেনা | অন্তত নির্ভুলভাবে জানে না এটুকুনি নিশ্চিত | তাতে ক্ষতি নেই, নাই বা জানুক | একসময় আমরা জানতাম নিশ্চয়ই, মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করিনি | মহাকাশের দূর-সীমান্তের ধাঁধা সমাধানে নিমজ্জিত আমরা, এদিকে মানবগোষ্ঠীর লোকাচারিতা এখনো ধাঁধাই রয়ে গেলো |

যাইহোক, আমাদের বঙ্গদেশে একসময় বোধকরি বহুরকমের গাজন দেখা যেত ৷ চৈত্রে শিবের গাজন, বৈশাখে ধর্মের গাজন এছাড়াও নাকি অন্যান্য মাসে হতো বিশালাক্ষী ও অন্যান্য আঞ্চলিক দেবতার গাজন | বাকিগুলো এখনো আদৌ হয় নাকি খোঁজ পাইনি | তবে 'ধর্মদেব' আর 'শিবঠাকুর' সম্ভবত এই নিমিত্তে মিলেমিশে একাকার হয়েছেন | পিঠু-পিঠি মাসে হতো কিনা | ছোটবেলা পড়েছি ‘অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট ৷’ এখন দেখছি অধিক দেবতায় বেশ কিছু গাজন নষ্ট না হলেও হারিয়ে গেছে |


গলি থেকে বেরিয়ে এলাম, হোটেল ফিরবো কিনা ভাবছি, সুদীপ্তের চোখ গেলো জিলিপির দিকে | পথের ধারে সারিসারি অস্থায়ী দোকান বসেছে | একগাদা করে জিলিপি আর নিমকি ঠোঙায় ভরে, আর মুঠো খানিক মুখে গুঁজে; আমরা এপাশ ওপাশ হাটছি | অমনি চোখ পড়ল পথের ধারের একটা পোস্টার-এ–

'২৯-শে ও ৩০-শে চৈত্র রাত্রিভর সং-সাজ কালীচালান

৩১-শে চৈত্র বিকেল ৪-টা কৃষ্ণদেবপুর হাইস্কুল প্রাঙ্গনে চড়কের মেলা

- পরিচালনায় কৃষ্ণদেবপুর রাজবংশী পাড়া, স্থাপিত - ১৩৫৯ '

চুলোয় যাক হোটেলে ফেরা, চুলোয় যাক ঘুম, আমরা মাঠে ফিরলাম |


রাত্রি ১১-টা বেজে ১৫,


বসবো বসবো করছি, তবে এখনো বসিনি | গ্রামের লোকজন ঘর থেকে প্লাষ্টিক বা চটের আসন এনে পেতে গোল করে মাঠের চারদিক ভরিয়ে দিয়েছে, এখনো লোক এসে চলেছে | এ'নারা ঠিক সময় জানেন, এদের কাছে প্রতিবছরের ব্যাপার, আমাদের মতো আনাড়ি নন | সুদীপ্তের হাতে ক্যামেরা দেখে এক গ্রামের ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন - 'সিনেমা করতে এসছো?' জানালাম হ্যাঁ | বললেন বসে পর এখনো দেরি আছে, পুজো শুরু হয়েছে, ঘন্টাখানেক লাগবে তারপর অনুষ্ঠান | জিজ্ঞাসা করলাম কতক্ষণের অনুষ্ঠান, বললেন শেষ হতে সেই সকাল হবে সাড়ে-৪টা মতো | মাইকে নাম ডাকা হচ্ছিলো পূজাপ্রাঙ্গনে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যাতে এসে যান | লক্ষ্য করলাম সকলেরই পদবি - 'রাজবংশী' |


মন্দিরটি ও তাতে চলা আচারাদি নিয়ে কিছু 'অবজারভেশন'-

মূল উপাস্য শিব ও কালী, ভক্তদের নৃত্যশৈলী বৈষ্ণব গোছের - মানে দু'হাত তুলে, লাল-বেশ পড়ে অনেকে গোল করে বসে, মাঝে দুটো বড় কলাপাতায় নৈবিদ্য সাজানো, মাঝেমাঝে তারস্বরে মহাদেবের রব, উপাসকের গলায় মোটা রুদ্রাক্ষের মালা, গায়ে পৈতে, পরনে লাল ধুতি | মন্ত্রচারণ হচ্ছিলো কিনা বুঝিনি, আওয়াজে ভরা মাঠে কিছুই শুনতে পাওয়া কঠিন | পূজাশেষে, একজন বেরিয়ে এসে মঙ্গল আরতি সহযোগে মাঠের চারিদিকে ঘুরলেন প্রত্যেকের কাছে শিখা পৌঁছে দিতে | কিছুক্ষন পর, আরেকজন একই কাজ করলেন একটি সাদা নেতানো ঝাঁটা সহযোগে; এরকমটি সিনেমায় দেখেছি শিখ গুরুদ্বারায় |


দিদি ক্লাস ১২-এ ধর্মমঙ্গল নিয়ে পড়তো বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে | আমার পালা আসার আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষাদপ্তর ঠিক করেন, ওতে বেশি সময় দেয়ার মানে নেই | তাই সিলেবাসটি খাটো করে ফেলা হয় | কুড়িয়ে-বাড়িয়ে যেটুকু জেনেছি, ৷ গাজনের উৎসব পালন করেন তথাকথিত নিম্নবর্গের লোকেরা - তাই পদবীতে 'রাজবংশী' ৷ শিবঠাকুরের গাজনের বহুকাল আগে থেকেই বাংলায় ধর্মের গাজন শুরু | ধর্মদেবতার মূর্তির বালাই নেই, গ্রামের দিকে গাছপালায় কতগুলো কালো পাথর রাখা থাকে, তার উপর কেউ ফুল, সিঁদুর ঢেলে দেয় - তৈরী হয়ে যান ধর্মঠাকুর ৷ নতুন 'বিজেপি-শিক্ষিত' বাঙালির ঘেটে ফেললে চলবে না, এ 'ধর্ম' যুধিষ্ঠিরের বায়োলজিক্যাল বাবা - ধর্মরাজ যম নয়, একেবারেই লৌকিক দেবতা ৷ বখতিয়ার খিলজির আমলের পর থেকে বাংলায় অর্থাভাবে, উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণেরা নতুন জীবিকা তৈরির প্রয়োজনে কিছু তথাকথিত নিম্নবর্ণের দেবতাদের গ্রাজুয়েট করিয়ে লৌকিক পাঁচালির সাথে একটু-আধটু সংস্কৃত মিশিয়ে 'জাতে তোলেন' | ধর্মঠাকুর তাদেরই একজন | আবার আরেকদল নিন্দুকেরা বলে, মুসলিম অনুপ্রবেশে বৌদ্ধধর্মে ঘাটা পড়ায়, তাদের পথচ্যুত এক শ্রেণী বৌদ্ধধর্মের থেকে 'ধর্ম' কে ভাঁড়িয়ে এনে তৈরী করে এই 'ধর্মঠাকুর' | বহুমুনির বহুমত আছে, আমি ঠিক জানি না | যদিও এখন জেনে বিশেষ লাভ নেই, সব গাজন-ই শিবে এসে ঠেকেছে |

একসময় নাকি শুধুমাত্র পতিত ব্রাহ্মণেরা-এ পূজা করতেন | আজ আমরা সবাই পতিত, তাই সে ঝামেলা নেই |


পূজা শেষে ডাক পড়লো দুই রাজবংশী ভাইয়ের | ষাটোর্ধ দুই ভাই এসে কিসব আওড়ালেন মাইকের সামনে, নেচে নেচে,দুলে দুলে | কিচ্ছু শুনতে পাইনি, মাইকটি খারাপ হয়ে গেছিলো, কারো সেদিকে বালাই ছিল না | যা বুঝলাম এ হলো গিয়ে 'আসর-বন্দনা' | এই দুই ভাই, যাদের নামটা ভুলে মাটি করেছি, তাদের পরিবার মন্দির সেবাইতের কর্ণধার | তাদের আসর-বন্দনার উপরুন্তুই শুরু হতে পারে রাত্রিকালীন অনুষ্ঠান | রাত প্রায় ১২-টা চোখ আমাদের ঢুলু-ঢুলু আসর ভিড়ে ভিড় | আমি আর সুদীপ্ত ক্যামেরা দাবা করে দৌড়ে বেড়াচ্ছি, চারদিকে একই জনরব - 'দেবের দেব, মহাদেব, হর-গৌরী, জয়শিব' (সম্ভবত) |


মধ্যরাত্রি প্রায় '১:১৫',


নিম্নবর্ণ উচ্চবর্ণ সব মিলে একাকার | জাতে আজকাল আর কিছু যায় আসে না, পয়সায় আসে | তাই অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে যারা, সে উচ্চ হোক কি নিম্ন তারা সবাই আজ গাজনে যোগ দিয়েছেন | শুরু হয়েছিল শিবের বিয়ে দিয়ে - অর্থাৎ 'সং সাজা' | সকল চরিত্র পুরুষ কি মহিলা, অভিনেতারা করেছেন, অভিনেত্রী নেই | এরপর একে একে দেখলাম কত কি - ধুনুচি নাচ, আগুন নাচ, গায়ে জ্বলন্ত শিক গুঁজে নাচ, সারা গায়ে বিচিত্র এক তেল মেখে আগুন নিয়ে খেলা, এক দুখানা খড়গ হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শরীরে আঘাত করে নাচ, চার-পাঁচটা খাঁড়া পেতে তার ওপর শুয়ে থাকা, কুঁলের কাটা বিছিয়ে তার ওপর কখনো গড়াগড়ি বা কখনো তা গায়ে জড়িয়ে নাচ, জানা ছয়েক লোক খড়গ পেতে আছে মাটি থেকে ফুট দুয়েক ওপরে আর একজন তার ওপর হেঁটে বেড়াচ্ছেন ইত্যাদি | তবে আশ্চর্য হওয়া তখন বাকি ছিল |


"ধ্বনি দেরি লজ্জা পাসনা - দেবের দেব ..." এর গগনভেদি আওয়াজ চারদিক ঘিরে রেখেছিলো তারই মাঝে ঘোষণা হলো তিনটি কালী নাচের - পোড়া কালী, বাঁধা কালী ও খুব সম্ভবত শ্মশানকালী - কানের অবস্থা ভালো ছিল না আমার |

কালী নাচের আগে কিছু হাস্যকৌতুক সৃষ্টিকারী আয়োজন ছিল | যেমন মুখ দিয়ে সুতো খেয়ে নাভি থেকে বার করা, গ্রামের একজোড়া বৃদ্ধ দম্পতির বিয়ে (সকল চরিত্রে পুরুষ অভিনেতা) ইত্যাদি |


হঠাৎ চারদিকের আলো নিভিয়ে ফেলা হলো, ঘটলো পোড়া (burnt ) কালির প্রবেশ | অন্ধকারে যতটা ঠাহর হলো, পোড়া কালী একজোড়া লোক যারা কোনো একধরণের পোশাক পড়ে ছিলেন যাতে আগুন লাগানো আর তারা নেচে বেরালে স্ফুলিঙ্গ ঠিকরে ঠিকরে পড়ে | বাঁধা (tied ) কালী কালো রঙের (এছাড়া তখন অন্ধকার) তার হাতে লাল রঙের খাঁড়া, তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে চালিত করছে একদল লোক, সে ছুটে বেড়াচ্ছে ভিড়ের দিকে শূন্যে খাঁড়া ছুড়ে | ভিড় ধাক্কাধাক্কি দিশাহীন | বাঁচবার চেষ্টায় আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত, ছবি তোলা দূর-অস্ত | শ্মশানকালির গায়ে সবুজ সাদা রঙে কঙ্কাল আঁকা, এছাড়া সর্বত্র কালো |

এসকল কালীনাচকে ওঁরা ডাকলেন ভুতের নাচ | সুদীপ্ত কে আমি ঢেলে তুলবার ডাক দিতে ও বললো, ও ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ভিডিও করছে, ওঠা অসম্ভব | কিন্তু পোড়াকালী তেড়ে আসতেই ওর ভীষ্ম প্রতিজ্ঞা ভেস্তে গেলো | মাথা আমাদের গমগম করছিলো, কোন আস্থাবলে মানুষ এসব করার সাহস পায় আমার জানা নেই, কোনোদিন জানবো বলে আসা রাখি না | ওই নাচ ভোলা কোনোদিনই আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে বলে মনে হয় না | যাই হোক, ভুতের নাচের আগে, কয়েকটি 'স্কিট' হয়েছিল যা বলতে বেমালুম ভুলে গেছি | মূলত শিবের নাচ, বা শিব ডুমরু বাজাচ্ছে আর একে একে নেচে চলেছে পার্বতী, কালী, কৃষ্ণ, কখনো বা পরীরা, কার্তিকের সাথে ময়ূর | একবার দেখলাম দূর্গা এসেছেন মহিষাসুর সহিত | তবে সেসব কালী নাচের কাছে পাত্তা পায় না |


শেষ রাত্রি, হয়তো '৩:৩৫', "ডিপ সাইকোএনালিসিস",

- 'আমরা দুজন ভাই | শিবের গাজন গাই || ঠাকুমা গেলো গয়া কাশী | ডুগডুগি বাজাই ||'

আজ ভেবে পাই না ভাই দুজনের কল্পনা শক্তি এতো সীমিত কেন? ছোটবেলা শাসন করার লোক না থাকলে কতধরনের দুষ্টামি আমার মাথায় আসতো, শুধু ডুগডুগি বাজিয়ে মন ভরতো কি?


ভোরের আলো তখন ফোটে নি,বা ফুটলেও আমাদের বোধগম্য হয় নি | দু'দল গাজন শিল্পী বচসা শুরু করলো | কোলাহলের চোটে সুদীপ্ত বললো ভাই চল কেটে পড়ি, খেপে গিয়ে আমাদেরই না পেটায় | একটা জিনিস লক্ষ করেছি, অন্য সকল ফটোগ্রাফার দের গ্রামের কোনো না কোনো বোদ্ধার সাথে সুসম্পর্ক ছিল | হয়তো তারা সকাল সকাল পৌঁছে আখের গুছিয়েছে, আমাদের সেগুড়ে বালি, এসেইছি রাতে | তাই সুদীপ্তর কোথায় রাজি হয়ে কিল-চর বাঁচিয়ে কোনা ধরলাম | অচেনা গলিপথে সাপের মতো ঘুরে মূল পথে উঠলাম কোনোক্রমে | সামনে আরেকদল গৃহী ফিরছিলো | তাদের কোথায় আড়ি পেতে জানলাম - "আগে পারে এতো মাস্তানি হতো না, এখন সবাই নেশাখোর মাস্তান, তাই ফি-বছরই ঝামেলা বাধে শেষ রাতে" |


অত সকালে রাস্তাঘাট ছিল জনশূন্য, কৃষ্ণপুর থেকে পায়ে হেটে আলো-আঁধারি রাস্তা ধরে যাত্রা শুরু করলাম |

- সুদীপ্ত - "আচ্ছা ভাই, এদের ব্যাথা লাগে না? খাঁড়া গুলো কি ভোঁতা"?

- আমি - "সে তো 'হায় হাসান, হায় হোসেনও লাগে না, লাগলেও কি আমাদের বলবে?"

একটা জিনিস খানিকটা আন্দাজেই বলছি ভুল হতে পারি, যারা শিল্পী এবং বহু পুরুষ দর্শক বা শিল্পী সহায়ক, সকলেই আকণ্ঠ নেশাগ্রস্থ ছিল | ফলে স্নায়ুর উদ্দীপনা বহন ক্ষমতা হয়তো কম ছিল | ব্যথা হলেও, বোধ ছিল না | এছাড়া আগুন খেলোয়াড়দের গায়ে চপচপে তেল মাখা ছিল | একজন হুমড়ি খেয়ে পড়তে আমার হাতে কিছুটা লেগে যায় | মনে হয়না সেটা আমার পরিচিত কোনো তেল | তাতে "হালুসিনোজেনিক" কিছু মেশানো থাকতে পাড়ার আশংকা করছি | এছাড়া কি বলুনতো, ব্যায়ামবিদের সহকারী হিসেবে বহুবার ১০ এর জাগায় বিশবার বন্ধুদের দিয়ে উঠবস করিয়েছি, 'পারবি পারবি' বলে চেঁচিয়ে | ওখানে যা দেখলাম, 'দেবের দেব মহাদেবের' নামোচ্চারণ এর সাথে নেশা মিলে, এক অলীক মোহনী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে | যেখানে এইধরণের অবিশ্বাস্য কাজ, কোন এক বিশ্বাসের হুজুগে করা যাই বইকি |


কৃষ্ণদেবপুর থেকে কালনা বাস স্ট্যান্ড, পায়ে হেটে আমাদের ঘন্টা দেড়েক লাগলো | পায়ের অবস্থা ভালো ছিল না, রাতে ঠিক করে খাওয়াও হয়নি | আমি সারাপথ বকবক করে গেছি | গাজন নিয়ে 'অফকোর্স' | রাতের অনুষ্ঠানে মূল ছিল শিব-পার্বতীর বিয়ে, চৈত্রের শেষ তিনদিন ভালো বৃষ্টি আর চাষের আসায় - শিবকে তুষ্ট করা | পুরো উৎসবটি ছয়দিনের,

  • প্রথমদিন, 'উপোষ' - গাজন সন্ন্যাসীরা নির্জলা উপোষ পালন করেন |

  • দ্বিতীয়দিন, 'হবিষ্যি' - সন্ন্যাসীর লাল বেশ ও পৈতে ধারণ |

  • তৃতীয়দিন, 'মহাহবিষ্যি' - মহাউপোষ ও অন্যান্য আচার |

  • চতুর্থদিন, ফলউৎসব - শুধুমাত্র ফলাহার |

  • পঞ্চমদিন, নীলের পূজা/উপোষ - মায়েরা উপোষ রাখেন সন্তানের শুভ কামনায়, এদিনই নাকি শিবের বিয়ে হয় নীলাবতীর সাথে, সে রাতে উৎসবে আমরা তাই দেখি |

  • আর শেষদিন 'চড়ক' তা নিয়ে বলবো আর কিছুক্ষনেই |

'শূন্যপুরাণে'র ধৰ্মঠাকুর সূর্যের দেবতা, মৃতের দেবতা | তার কাহিনী বাঙালি শিব নীলেশ্বর, বনেশ্বর, ক্ষেত্রপাল ও লাঙ্গলেশ্বর-এর সাথে বহুস্থানেই মিলেমিশে একাকার | তার উপাসনায় প্রাগাধুনিক শৈববাদ, তন্ত্রবাদ, বৈষ্ণববাদ এমনকি ইসলামিক সংস্কৃতিও মিশে | আবার শূন্যপূরণের 'শূন্য' বৌদ্ধধর্মে তিরস্কৃত 'অর্থহীন' বৈষয়িকতার দৌতক | তাই কিসের উৎসব দেখছিলাম তা বোঝাতে জিজ্ঞেস করবেন না | যা দেখেছি লিখে চলেছি |


৪:৩০-এর আশেপাশে হোটেল পৌছালাম, সুদীপ্ত মশার কামড় সহ্য করে বাস স্ট্যান্ড এই শুতে গেছিলো | আমি 'গুগল' করে হোটেল মালিকের 'নম্বর' জোগাড় করে তার ঘুমে জল ঢাল্লাম | দরজা খুলে 'রুম'-এ পৌঁছে ঘন্টা পাঁচের ঘুম লাগলাম |


১৪-ই এপ্রিল ২০২১,


বিকেল '৩:৪৫',


হোটেল রিসেপশনিস্ট এর 'পিয়াজি' কম নয় | বলে ২ টার মধ্যে না গেলে আজ মাঠে ঢুকতেই পারবেন না | 'নেড়া বেলতলায়..' মনে পড়ে গেলো | আজ নো পাকামি | কালকেই পোস্টার দেখি এসেছি, খেয়ে দেয়ে অটো ধরলাম ঠিক ৪ টায় পৌছাবো ধরে |


আজ গন্তব্য কৃষ্ণদেবপুর হাইস্কুল প্রাঙ্গন | পৌঁছে দেখি, মাঠে মোটামুটি ভিড়, কালকের থেকে অনেক বেশি ফটোগ্রাফার দের ভিড় | মাঠটি কালকের একপলতা মাঠের চেয়ে অনেক বড়ো | দু'ধার ঘেয়ে দোকান, যেমন বাংলায় মেলায় বসে আর কি | ঠিক মাঝখানে একটা বড়ো গর্ত, গর্তের পাশে ফুট তিরিশেকের লম্বা বৃক্ষ কান্ড শোয়ানো - অর্থাৎ চড়ক গাছ |

কান্ডটি নাকি সম্পূর্ণ সোজা হওয়া আবশ্যক | একদল সন্ন্যাসী ক্রমে তার উপাসনা শুধু করলো, তার আগে কালকে রাতে ব্যবহৃত একটা কালির মুখোশ এনে চড়ক গাছে বেঁধে ফেলা হলো | তৈরী হলো অর্ধনারীশ্বর | চরকের পূজা চলাকালীন, আরেকদল দুটি লম্বা বাঁশকে কিছু কাঠ সহযোগে পাশে বসে বাঁধছিলো মাঝামাঝি একটা গর্ত তৈরী করে | পূজা শেষে চড়কের মাথায় আড়াআড়ি বাঁশের কাঠামোটি বেঁধে, দড়ি ধরে টান দিয়ে জানা তিরিশ লোক টেনে তুললো মহাদেবের নাম নিতে নিতে | চড়কের ভিত ঢুকলো গর্তে, স্থাপিত হলো ডানাওয়ালা চড়ক |


আরো ঘন্টা দেড়েক মাঠে ছিলাম, দেখলাম কিছু সন্ন্যাসী পিঠে চামড়া ফুটো করে আঁকশি বেঁধে দড়ির সাথে নিজেদের ঝুলিয়ে দিচ্ছে চড়ক গাছের ডালে | কিছুলোক ধরে তাদের গোল গোল দল ঘোরাচ্ছে চারদিকে | একেকজনের পিঠে বহু পুরানো গর্তের দাগ | এরা বহুবছরের পুরানো শিল্পী | নব্য একজন একপাকেই অজ্ঞান হয়ে গেলো | এছাড়া চড়ক গাছের চারিদিকে পরিক্রমা দিচ্ছিলো আরেকদল সন্ন্যাসী মুখে লম্বা লম্বা লোহার শিক গুঁজে, কেউ ঠোঁটে কেউবা কানে | শিকের দু'ধরে ফল গোজা, ভক্তের মুখে শিবের নাম | কি সাহসী, কি বীভৎস এ ভক্তি | মায়েরা বাচ্চাদের তুলে দিচ্ছেন একেএকে চড়ক ডালে পাক খাওয়া সন্ন্যাসীর কোলে, এতে নাকি শিশুর ভবিষ্যৎ মঙ্গলময় হয় | এর কারণ কি? - আজকাল আমরা আর কারণ নিয়ে ভাবি না | বেশিরভাগ ভক্তিই অন্ধ, তবে আকর্ষণীয় বটে |


চড়কের ডালে মানুষের দেহমনের শক্তির পরীক্ষা হয়, পরীক্ষা হয় বিশ্বাসের | বোদ্ধারা লিখে গেছেন, এই ভাবে শারীরিক কষ্টের মাধ্যমে পুরুষেরা - নারীদের প্রসব কালীন বেদনা 'সিমুলেট' করে | মোক্ষলাভের আগে নাকি ইহা করা আবশ্যক | কেউ বা বলে, চড়ক এসেছে 'চক্র' থেকে | যেই চাকা সূর্যের পরিক্রমা কে বোঝায় - এটা নাকি রাজা সুন্দরানন্দ ঠাকুর ১৪৮৫ সনে শুরু করেন, যদিও বহু খুঁজেও তার আর কোনো হদিশ পাই নি | যেকারণেই করুক কেন, আমার মতো অর্বাচীনের এসব দেখে পিলে চমকে যাওয়ার সামিল |


সন্ধ্যে '৬ টা',


পরের দিন বাংলা নববর্ষ, আজ ফিরতেই হবে | হোটেল ও ছেড়ে এসেছি | তাই বেড়াতে বাধ্য হলাম, আয়োজন দেখে মনে হলো সেদিন রাত ১০ টা অবধি মেলা চলেছে, হয়তো আরো বহু ধরণের সাহসী খেলাও দেখানো হয়েছে | সেসব দেখিনি, তবে আক্ষেপ নেই, যা দেখলাম অনেক |


ফেরার সময় ফেরি পেরিয়ে শান্তিপুর থেকে ট্রেন ধরলাম, স্টেশন পৌঁছানোর পথে দেখি শান্তিপুরের মাঠেও চড়ক গাছ, কিছু সংসাজের শিল্পী দেখলাম স্টেশনে | বুঝলাম আশেপাশে বহুস্থানেই বিভিন্ন পরিসরে চড়ক মেলা হয় | একটাই আফসোস স্টেশন এর ধরে মিষ্টির দোকানের দোকানি এক কেজির কম লাল দই বেচলেন না | ঘরে আর কেউ খায় না, তাই নষ্ট করার মানে হয় না বলে, এ যাত্রায় লাল দই অধরা থেকে গেলো |


'আমাদের কথা ফুরালো', চড়ক গাছ কি 'মুড়ালো' কিনা খোঁজ নেয়ার উপায় ছিল না ||


References:

  1. Wikipedia.

  2. Personal experience.

  3. Agriculture, Floriculture and Botanical Knowledge in a Middle Bengali Text, Ch.11, Fabrizio M. Ferrari1

Commenti


আমার সম্পর্কে

পেশায় আমি সফ্টওয়্যার গুণমান বিশ্লেষক | তুলনামূলক ধর্ম,  সামাজিক ইতিহাস, ল্যান্ডস্কেপ ভ্রমণ এবং অরিগামিতে আমার অভিরুচি।

 

আরও পড়ুন

  • White Facebook Icon

© 2018-2022  নীতীশ ভট্টাচার্য

bottom of page